বিসিএস : প্রিলিমিনারি প্রশ্নপত্রের ধরনের অপ্রাসঙ্গিকতা
র্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘বিসিএস’ এমন একটা শব্দ যার সাথে অনেক যুবকের স্পন্দন জড়িয়ে আছে। লাখো যুবকের স্বপ্ন এই বিসিএস। সরকারি চাকরিতে ক্রমবর্ধমান সুযোগ সুবিধা এবং বেসরকারি সেক্টরে চাকরির অনিশ্চয়তার কারণে বিসিএস নামক এই সোনার হরিণ ধরার জন্য প্রতিনিয়ত লাখ লাখ যুবক-যুবতী আগ্রহী হচ্ছে। আবারো সেই যুদ্ধের সময় চলে এসেছে।
৪১তম বিসিএসের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে পিএসসি। যখনই বিসিএস পরীক্ষার বা আবেদনের সময় আসে তখন আমার মাথায় কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। যেহেতু বিসিএসে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত থাকবে এবং জাতির উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণের প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত থাকবে তাই স্বাভাবিকভাবেই এই প্রার্থী নির্বাচনের পদ্ধতি এমন হওয়া উচিত যেখানে এই গাম্ভীর্যের এবং গুরুত্বের প্রতিফলন থাকবে। প্রথম শ্রেণীর বিসিএস ক্যাডার নির্বাচনের প্রথম ধাপে প্রার্থীরা
প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো এই প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরন কি ভবিষ্যত আমলা নির্বাচনের জন্য যথাযথ? বিসিএস প্রিলিমিনারি প্রশ্নপত্রের ধরন কি একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্য সম্পাদন করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত দক্ষতা ও মানসিক ক্ষমতা আছে কিনা তা পরক্ষ করার জন্য যথেষ্ট?
আমরা বিভিন্ন সময় পত্রিকায় সরকারী কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অনিয়ম ও অদক্ষতার খবর দেখতে পায়। যখন খবর পড়ি তখন নিজেদের মধ্যে এমন আলোচনাও করে থাকি যে ‘এই লোক নিয়োগ পেলো কিভাবে’? আসলে ঐ অদক্ষ মানুষগুলো নিয়োগ পেয়েছে কারণ নিয়োগের জন্য যে প্রশ্ন পদ্ধতি ফলো করা হচ্ছে সেটিই ভুল। এই পদ্ধতিতে এমআইটি পড়ুয়া কোন প্রকৌশলী সরকারী চাকরির জন্য উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হবে।
বিসিএস প্রিলিমিনারিতে বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, তথ্য প্রযুক্তি, সাধারণ জ্ঞান (বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়সমূহ) ইত্যাদি বিষয় থেকে প্রশ্ন সেট করা হয়। প্রশ্নপ্রত্রটি ঠিকমতো স্ক্যান করলে বেশ কিছু প্রশ্ন মাথায় আসবে। প্রথমত, আপনার দায়িত্ব পালনের বা আপনার পেশাগত কাজটি সম্পাদনের জন্য আপনার কী দরকার? খুব সহজভাবে বললে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে ঐ নির্দিষ্ট কাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষতার প্রয়োজন।
এখন প্রশ্ন হলো প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় যে ধরনের প্রশ্ন সেট করা হয় সেগুলো কি কোন প্রার্থীর ঐ ধরনের দক্ষতা (পেশার ধরনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ) আছে কি না তা নিরীক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত? কখনোই না কারণ প্রিলিমিনারি পরীক্ষার অনেক প্রশ্নই কিছু ক্যাডারদের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়। সহজ ভাষায় ঐ প্রশ্নগুলো নির্দিষ্ট পেশা বা ক্যাডারের প্রকৃতির (যেমন প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষা ইত্যাদি) সাথে মোটেও প্রাসঙ্গিক নয়। যেমন ধরুন- একজন ভাল পুলিশ অফিসার হওয়ার জন্য কি দরকার? যদি কেউ একজন দক্ষ পুলিশ অফিসার হতে চায় তবে তার অবশ্যই বিশ্লেষণ ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা, মাল্টি-টাস্কিং দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের প্রত্যুৎপন্নমতিতা এবং দেশের আইন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নগুলো কি এই গুণাবলীগুলো পরীক্ষা করে?
অবশ্যই না- এর মানে হলো কোনো প্রার্থীর মধ্যে ঐ নির্দিষ্ট গুণাবলি থাকলেও সে পরবর্তী স্তরের (লিখিত পরীক্ষা) জন্য নির্বাচিত নাও হতে পারে, তবে যেসব প্রার্থীদের ঐ নির্দিষ্ট দক্ষতা/জ্ঞান নেই কিন্তু নির্দিষ্ট বিষয় (সাধারণ জ্ঞান, বাংলা ইত্যাদি) সম্পর্কিত তথ্য মুখস্ত করতে পারবে তাদের পরবর্তী ধাপের জন্য নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এক কথায় বলা যেতে পারে যে প্রিলিমিনারি প্রশ্নের ধরন দক্ষতা/যোগ্যতা নির্ভর নয়। বরং অনেক বেশি মুখস্থ বিদ্যা নির্ভর। ফলস্বরূপ এটা প্রায়ই দেখা যায় যে বিসিএসে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের অনেকেই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে গভীর জ্ঞান প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়।
এমন ভুল প্রশ্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রচুর যোগ্য বেকারদের প্রতি একরকম অবিচার করা হচ্ছে। বিশেষত কিছু ক্যাডার এর ক্ষেত্রে প্রিলিমিনারি প্রশ্নের ধরন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ও হাস্যকর। উদাহরণস্বরূপ- কেন একজন ডাক্তারকে বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্যের সাথে সম্পর্কিত তথ্য মুখস্থ করতে হবে? আবার একজন প্রকৌশলীর জন্য জীববিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত কিছু মুখস্থ করার প্রয়োজনীয়তা কী? বরং একজন প্রকৌশলীর তার নিজের কাজটি নিখুঁত ও দক্ষতার সাথে করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত দক্ষতা আছে কিনা তা যাচাই করে দেখা উচিত।
কিন্তু পিএসসি এমনটি করতে ব্যর্থ হয় বলেই ভুল মানুষ ভুল জায়গায় নিয়োগ পেয়ে যায়। আর এমন ভুলের মাসুল কিন্তু এই দেশ ইতিমধ্যে দেয়া শুরু করেছে। ভুল মানুষ ভুল জায়গায় নিয়োগ পেয়েছে বলেই কিন্তু এই দেশে এমন ঘটনাও ঘটেছে যে ফ্লাইওভারে সিগন্যাল বসাতে হয়েছে। প্রকৌশলীর অদক্ষতার কারণেই কিন্তু এমন ভুল নকশা হয়েছে এবং সেই নকশা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে অনুমোদনও পেয়েছে। ঠিক একই রকম ভুল হচ্ছে সরকারি কলেজে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় যে সরকারি কলেজে শিক্ষক হওয়ার জন্য একজন প্রার্থীকে তার বিষয়ে তার কতটুকু দক্ষতা আছে তা প্রমাণ করতে হয় না। বরং অন্য সব বিষয়ে ভালো করলেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সম্ভব। আর এমন ভুল পদ্ধতির কারণেই সরকারী কলেজগুলোতে অদক্ষ শিক্ষকরাও নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ঐসব কলেজের শিক্ষার মানের উপর।
এতসব কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই- আসলে গোড়াতেই গলদ। এমন হাস্যকর নিয়োগ পদ্ধতির পরিণতি হলো একটি ‘ব্যর্থ আমলাতন্ত্র’। আমরা বিভিন্ন সময় পত্রিকায় সরকারী কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অনিয়ম ও অদক্ষতার খবর দেখতে পায়। যখন খবর পড়ি তখন নিজেদের মধ্যে এমন আলোচনাও করে থাকি যে ‘এই লোক নিয়োগ পেলো কিভাবে’? আসলে ঐ অদক্ষ মানুষগুলো নিয়োগ পেয়েছে কারণ নিয়োগের জন্য যে প্রশ্ন পদ্ধতি ফলো করা হচ্ছে সেটিই ভুল। এই পদ্ধতিতে এমআইটি পড়ুয়া কোন প্রকৌশলী সরকারী চাকরির জন্য উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হবে। এমনকি আমি নিশ্চিত যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের প্রফেসরকে পরীক্ষা দিতে বললে সেও সরকারি কলেজের প্রভাষক হতে ব্যর্থ হবে। এমন পরিস্থিতিতে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নের ধরন পুনর্বিবেচনা করা খুবই প্রয়োজন যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সবচেয়ে যোগ্য মানুষগুলো নিয়োগ পেতে পারে।